একটা সময় ছিল যখন চিলেকোঠার ঘরে বসে কবিতা লিখতাম। সেই সব কবিতার স্মৃতিটুকু ছাড়া আজ আর কিছু অবশিষ্ট নেই। তারপরে কলেজে পড়ার সময়ে ‘অর্কুট’-এর ‘কুট সাহিত্য’ কমিউনিটিতে আর ‘লোটাকম্বল’ ব্লগ পত্রিকায় কবিতা-ই লিখেছি। গল্প কোনোদিন লিখব সেই স্বপ্নও আমার ছিল না। আমি কোনোদিনই গল্প বলিয়ে ছিলাম না।
২০০৮ সালের একেবারে শুরুতেই কর্মসূত্রে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে চলে যাই। সে এক আশ্চর্য জীবন-যাপন। রুক্ষ মাটির ভিতর থেকে উঠে আসা গন্ধ, টাউন-শিপের কোয়ার্টারে জানালা খুলে দিলেই গম্ভীর পাহাড়, ভারিক্কি সবুজের পেট চিরে শীর্ণ কাঁকুরে রাস্তা উঠে গেছে, মহাদেবের জটায় জড়িয়ে থাকা সাপের মতো। কোনোদিন সকালে দেখতাম মেঘ ঝুঁকে আছে জানালার আছে। ভাষাহীন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মনের ভিতরে নানা ভাবনা উপচে আসত। ইচ্ছা হত কাউকে সেই সব কথা বলি। কিন্তু সঙ্গীহীন জীবনে কাকে বলব? খাতা কলম তুলে নিলাম হাতে। ভাবনার সঙ্গে কথা বলার ছলে লেখা হতে থাকল গদ্য। গদ্যের হাত ধরে এল গল্প। জানালার পিছনে রাস্তা আর সেই রাস্তার গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গম্ভীর পাহাড়টি যেন আমার ঘাড় ধরে লেখাতে থাকল গল্প। একদিন টাটানগর স্টেশনে অপেক্ষা করছি ট্রেনের জন্যে। ট্রেন লেট। ‘জন-আহার’র ক্যান্টিনে, কোনার দিকে একটি নির্জন টেবিলে বসে বসে লিখে ফেললাম একটা গল্প ‘মাধ্যাকর্ষণের বাইরে’। এ যেন নিজের কাছে নিজের অন্বেষণ। সেদিন বুঝলাম গল্পের থেকে আমার আর মুক্তি নেই। পুরুলিয়া পর্বের সেই সব গল্পের অনেকগুলি সংকলিত হয়েছিল ‘সৃষ্টিসুখ’ থেকে প্রকাশিত আমার ‘আয়না ঘর’ বইতে। আমার প্রথম বই।
তারপরে পুরুলিয়া থেকে আবার হাওড়ায় ফিরে আসার পরে কাজের প্রভাবেই হয়তো গল্পের ভঙ্গি বদলে যেতে থাকে। চারপাশের মানুষের কথা খুব বলতে ইচ্ছা হয়। হেরে যাওয়া, আহত মানুষের কথা। মানুষের ব্যর্থ স্বপ্ন, না-পাওয়ার কথা। সেই সঙ্গে লেখা হতে থাকে রহস্য গল্প। প্রথম রহস্য গল্প প্রকাশিত হয় ‘উনিশ কুড়ি’ পত্রিকায়। এই সংকলনের গল্পগুলি মূলত ২০১৩ থেকে ২০১৯ এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে লেখা। এই বইয়ের প্রথম গল্প ‘ধস’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘তথ্যকেন্দ্র’ পত্রিকায়, ২০১৪ সালে। পর পর বেশ কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয় বিভিন্ন অন্তর্জাল ও ছাপা পত্রিকায়।
কিন্তু সমস্ত গল্পগুলি এক ধারাবাহিক লেখনভঙ্গির ফসল নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেমন মানুষের জীবন যাপন, পরিবেশ পরিস্থিতি, বেঁচে থাকার লড়াই বদলেছে, তেমনই সেই সব পরিবর্তিত জীবনের, স্বপ্নের, ব্যর্থতার প্রভাব পড়েছে গল্পে। লেখার ভঙ্গিতে। চলমান জীবন, মানুষ আর বর্তমান সময়কে বাদ দিয়ে কখনও লেখার চেষ্টা করিনি। মানুষের পরাজয়, ব্যর্থতা, না-পাওয়া জীবন, যা সে স্বপ্নে দেখে, তার অসহায়তা, তার অসততা বারবার আমাকে নাড়া দিয়েছে। আমার গল্প আলো-আঁধারের গল্প। এক দীর্ঘ আর চলমান সময় থেকে আলগোছে তুলে নেওয়া খণ্ড খণ্ড চিত্র যেন।
এই ছয়-সাত বছরের কিছু কিছু নির্মাণ গল্পের অছিলায় অচেনা পাঠক আপনার হাতে অঞ্জলি ভরে তুলে দিলাম। পড়বেন এই আশাও অতটা করছি না। তবু অক্ষরের গায়ে আঙুল বোলাতে বোলাতে হয়তো কোনও এক অলৌকিক মুহূর্তে, কালো অক্ষরে বন্দি সময়ের সঙ্গে আপনার সময়ের দেখা হয়ে যাবে। তা যদি হয়, সেই হবে লেখক হিসাবে আমার পরম পুরস্কার।
অবিন সেন