রিচার্ড ডকিন্স
ক্লিনটন রিচার্ড ডকিন্স সুপরিচিত রিচার্ড ডকিন্স নামেই। তাঁর প্রশিক্ষণ আর পেশাগত ক্ষেত্র প্রাণিবিজ্ঞান, বিশেষ করে ইথোলজী (প্রাণিবিজ্ঞানের যে শাখায় বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক ও নৈর্ব্যাক্তিকভাবে প্রাণীদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করে থাকেন) এবং বিবর্তন জীববিজ্ঞান। ব্রিটিশ সরকারের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা বাবার কাজের সুবাদে তাঁর জন্ম এবং শৈশব কাটে আফ্রিকায়। বাবা এবং মা, দুজনেরই আগ্রহ ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে, আর পারিবারিক সেই আগ্রহটিও সঞ্চারিত হয়েছিল শিশু ডকিন্সের মনে। জীবজগতের দৃশ্যমান নানা রুপ আর বৈচিত্র্যময়তার একটি বিকল্প ব্যাখ্যা হিসাবে মধ্য কৈশোরেই চার্লস ডারউইনের প্রস্তাবিত বিবর্তন তত্ত্বটি তাঁকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল; উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন জীববিজ্ঞান। অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজে প্রাণিবিজ্ঞানে ১৯৬২ সালে স্নাতক এবং বিশ্বসেরা ইথোলজিষ্ট ও জীববিজ্ঞানী নিকোলাস টিনবার্গেন (১) এর তত্ত্বাবধানে তিনি পিএইচডি শেষ করেন ১৯৬৬ সালে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলীতে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ডকিন্স তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন, কিন্তু শিক্ষক ‘নিকো’ টিনবার্গেন তাঁর প্রিয় মেধাবী ছাত্রটিকে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অক্সফোর্ডে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭০ সালে অক্সফোর্ডে প্রাণিবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, পরবর্তীতে এই বিভাগের রিডারও (২) হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে বিখ্যাত সফটওয়্যার প্রকৌশলী চার্লস সিমোনী (৩) বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য আর জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে অক্সফোর্ডে রিচার্ড ডকিন্সের জন্য একটি বিশেষ অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করেন, Simonyi Professorship for the Public Understanding of Science (৪), এই পদ থেকে ২০০৮ এ অবসর গ্রহন করেন তিনি ।
পেশাগত জীবনের শুরুতেই তিনি অনুভব করেছিলেন যে, চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তন বিষয়টি নিয়ে বহু জীববিজ্ঞানীর মধ্যেই কিছু মৌলিক ভ্রান্ত ধারণার অস্তিত্ব আছে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কয়েকজন তাত্ত্বিক বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, জর্জ ক্রিস্টোফার উইলিয়ামস (৫), জন মেনার্ড স্মিথ(৬ ), ডাবলিউ. ডি. হ্যামিলটন(৭ ) ও রবাট ট্রিভার্স (৮ ) এর কিন সিলেকশন, অ্যালট্রুইজম বা পরার্থবাদীতা, পারস্পরিক পরার্থবাদীতা, সন্তান প্রতিপালনে পিতামাতার বিনিয়োগ সংক্রান্ত গাণিতিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলো বিষয়গুলি নিয়ে একটি সহজবোধ্য ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার জন্য। ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘটের ফলে সৃষ্ট বিদ্যুত সরবাহ ঘাটতির সময় যখন তার ঝিঝি পোকা (ক্রিকেট) নিয়ে গবেষণার কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না, সেই অবসরে ধারণাগুলো তিনি লিখে ফেলেছিলেন একটি বহনযোগ্য ছোট টাইপরাইটারে, ১৯৭৬ সালে সেই ভাবনাগুলো তাঁর প্রথম বই ‘দ্য সেলফিশ জিন (The Selfish Gene)’ রুপে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘দ্য সেলফিশ জিন’ খ্যাতি এনে দিয়েছিল তাঁকে।এখানেই প্রথমবারের তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনী চাপের শক্তি যে ইউনিট বা এককের উপর তার প্রভাব ফেলে ক্রম বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়, সেই জিন-কেন্দ্রিক বিবর্তনের ধারণাটি সুপরিচিত করার প্রচেষ্টা করেছিলেন, একই সাথে তিনি সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একক হিসাবে মিম (Meme) ধারণাটিও প্রস্তাব করেছিলেন। তার এই বইটির নামকরণ নিয়ে ভিত্তিহীন বিতর্ক চলেছে বহুদিন, তারই প্রত্যুত্তরে ১৯৮২ সালে বিবর্তন জীববিজ্ঞানে তিনি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা করেন, ‘দি এক্সটেণ্ডেড ফেনোটাইপ (The Extended Phenotype)’ বইয়ে, জিনের ফেনোটাইপিক (পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব এমন বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য) প্রভাব শুধু সেই জিন বাহকের শরীরেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সম্প্রসারিত হতে পারে প্রাকৃতিক পরিবেশে এবং এমনকি অন্য কোন জীবের শরীরেও। অতিপ্রাকৃত কোন পরিকল্পক, সৃষ্টিকারী সত্তার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ডকিন্স ব্রিটিশ হিউম্যানিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন(৯ ) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ব্রাইটস মুভমেন্টের(১০) সমর্থক। তিনি সুপরিচিত ধর্মভিত্তিক সৃষ্টিতত্ত্ববাদ আর এর ছদ্মরুপে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন মতবাদের বিরুদ্ধে তার সুদৃঢ় অবস্থানের জন্য। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্য ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার (The Blind Watchmaker) বইটিতে তিনি উইলিয়াম পেইলির (১১) ‘ওয়াচমেকার’ বা ঘড়ি নির্মাতা রুপকটির বিপক্ষে তাঁর যুক্তি উপস্থাপন করে ব্যাখ্যা করেন, জীবজগতে দৃশ্যমান সব গঠনগত জটিলতা ব্যাখ্যা করার করার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃত সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই। তিনি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মূল চালিকা শক্তি প্রাকৃতিক নির্বাচনকেই চিহ্নিত করেন ‘অন্ধ’ ওয়াচমেকার হিসাবে।
বিবর্তন জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন, ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে টানাপোড়েন ইত্যাদি নানা বিষয় বোধগম্য করার লকেব তিনি আরো বেশ কিছু বই লিখেছেন, যেমন, River Out of Eden: A Darwinian View of Life (১৯৯৫), Climbing Mount Improbable (১৯৯৬), Unweaving the Rainbow (১৯৯৭), A Devil‘s Chaplain (২০০৩), The Ancestor‘s Tale (২০০৪)। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্য গড ডিল্যুশন (The God Delusion) বইটি। যেখানে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, অতিপ্রাকৃত কোনো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই এবং ধর্মীয় বিশ্বাস একটি ডিল্যুশন বা বিভ্রান্তি বা স্থির ভ্রান্ত একটি বিশ্বাস মাত্র। ২০১০ সালের মধ্যেই বইটির বিক্রি দুই মিলিয়ন কপি ছাড়িয়ে যায় এবং তাকে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
ডারউইন জন্মদ্বিশতবার্ষিকীতে বিবর্তনের সপক্ষে গবেষষালব্ধ প্রমাণগুলো হালনাগাদ করে তিনি প্রকাশ করেন The Greatest Show on Earth: The Evidence for Evolution (২০০৯); ২০১১ সালে কিশোরদের উপযোগী করে লেখেন The Magic of Reality: How We Know What's Really True; তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব An Appetite for Wonder: The Making of a Scientist প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালে, যার দ্বিতীয় পর্ব Brief Candle in the Dark: My Life in Science প্রকাশিত হবার কথা ২০১৫ র শেষে । তাঁর সর্বশেষ বই Science in the Soul: Selected Writings of a Passionate Rationalist প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালে অক্টোবরে কিশোরদের জন্য লেখা তার Outgrowing God: A Beginner’s Guide to Atheism বইটি প্রকাশ হবে।
রেডিও ও টেলিভিশনের নানা অনুষ্ঠান ও বিতর্কে তাঁর উপস্থিতি একসময় ছিল বেশ নিয়মিত, এছাড়াও লিখেছেন বহু প্রবন্ধ। বহু পুরস্কারে সন্মানিত রিচার্ড ডকিন্স বিবর্তন জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা, ছদ্মবিজ্ঞান, ধর্মীয় ও অন্যান্য নানা কুসংস্কার নিয়ে তার আজীবন যুদ্ধের অংশ হিসাবে তৈরী করেছেন বেশ কিছু প্রামাণ্য চিত্র, যার সাম্প্রতিকতমটি হচ্ছে ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত The Unbeleivers। তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি বই বিশ্বের সব প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিজ্ঞানমনষ্কতা আর মুক্ত চিন্তার প্রসারে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাওয়া ডকিন্স প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘রিচার্ড ডকিন্স ফাউন্ডেশন ফর সায়েন্স অ্যান্ড রিজন (Richard Dawkins Foundation for Reason and Science) (১২) । ফাউেন্ডশনটি ২০১৬ সালে সেন্টার ফর ইনকোয়ারীর (Center for Inquiry) সাথে একীভুত হয়েছে।
পেশাগত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র চিকিৎসা বিজ্ঞান, চিকিৎসা অণুজীববিজ্ঞান, রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য। অনুবাদক, আগ্রহের ক্ষেত্র জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞানের ও শিল্পকলার ইতিহাস, সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মিথস্ক্রিয়া। ব্যক্তিগত ব্লগ: জীবনের বিজ্ঞান (১৩)। প্রকাশিত অনুবাদ: দ্য গড ডিল্যুশন (অনার্য এবং সেইবই ইবুক সংস্করণ), ওয়েজ অব সিইং (অনার্য), দর্শনের সহজ পাঠ (দিব্য প্রকাশ), সভ্যতা: একটি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি (দিব্য প্রকাশ), দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ (দিব্য প্রকাশ), দেখার দৃষ্টিভঙ্গি (দিব্য প্রকাশ), দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং ( সেইবই, ইবুক), ইসলাম ও সহিষ্ণুতার ভবিষ্যৎ: একটি সংলাপ ( সেইবই, ইবুক)।