অনিরুদ্ধর নতুন উপন্যাস ‘একা অন্য’ পড়তে গিয়ে পাঠক একটু মানসিক হোঁচট খেতে পারেন, এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণটি করে রাখাই ভালো। উপন্যাসটি নতুন ফর্মে লেখা - মোনলোগ। ইংরেজি ভাষায় মোনলোগ ভিত্তিক উপন্যাস থাকলেও (তার একটি বিখ্যাত উদাহরণ হল জেমস জয়েসের অসাধারণ উপন্যাস Ulysses) বাংলায় সম্ভবতঃ নেই। সেই হিসেবে অনিরুদ্ধকে এ ব্যাপারে পথিকৃৎ বলা চলে।
উপন্যাসটির প্রটাগনিস্ট একজন নারী নিজের জীবনের অবরোহণ, আরোহণ এবং উত্তরণের কাহিনি বলে গেছে স্বগতোক্তির মতো। যদিও একটি মানুষের জীবনকে এইভাবে অবরোহণ, আরোহণ এবং উত্তরণ এই তিনভাগে ভাগ করে সেই গল্প বলার স্টাইলটা নতুন নয়, কিন্তু লেখক এই অবরোহণ, আরোহণ এবং উত্তরণকে এক নতুন দৃ্ষ্টিতে দেখিয়েছেন। অবরোহণ পর্বে নব রসের উপর ভিত্তি করে উপন্যাসটির প্রটাগনিস্ট অভিশ্রীর জীবনের কালো সময়কালের পর্যালোচনা করা হয়েছে। আরোহণ পর্বে আবার একটি চমক - অভিশ্রী বৌদ্ধ দর্শনের অস্টমাঙ্গিক মার্গকে আঁকড়ে ধরে তার জীবনের অন্ধকার থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার লড়াই করছে। আর উত্তরণ পর্বে দেখা যাচ্ছে সে মান্ডুক্য উপনিষদের ব্রহ্মজ্ঞান শিক্ষার আলোয় নিজের জীবন দর্শন গড়ে নিজের জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেয়েছে।
জনান্তিকে হবু পাঠকদের জানাই, ‘নব রস’, ‘অস্টমাঙ্গিক মার্গ’ বা ‘মাণ্ডুক্য উপনিষদ’ শুনে আশঙ্কিত বা শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। লেখকের গল্প বলার ধরণটা এমনই যে পাঠক বুঝতেই পারবেন না কখন গল্পের প্রটাগনিস্টের অবরোহণ, আরোহণ এবং উত্তরণের কাহিনি একটি মেয়ের জীবনের গণ্ডি ভেঙে একজন জেনডার-বিহীন ‘মানুষ’-এর জীবনের অবরোহণ, আরোহণ এবং উত্তরণের কাহিনি হয়ে উঠেছে, যে ‘মানুষ’-টি পাঠক নিজেও হতে পারে।
আমরা নিজেদের জীবনে ইঁদুর দৌড়েই ব্যস্ত থেকে পরমায়ুটা শেষ করে ফেলি। নিঝুম সন্ধ্যায় কুলায়ে ফেরা পাখির ঝাঁকের কাকলি না শুনে লাইট জ্বেলে ঘরে ঢুকে টিভির সামনে বসে পড়ি। গভীর রাতে রাত জাগা কালপুরুষের একাকীত্বের যন্ত্রণা বা অ্যানড্রোমিডা গ্যালাক্সির আড়াই মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে ছুটে আসা আলো কী খবর বয়ে নিয়ে এল, তা বোঝার চেষ্টা না করে ঘর অন্ধকার করে ঘুমিয়ে পড়ি। ধ্রূবতারার অচলতা আমাদের সেই সত্ত-রজ-তমর ওপাড়ের অব্যয় অচল অদৃশ্য মহাশক্তির কথা মনে করায় না, আমরা ধ্রূবতারা না চিনেই জীবন কাটিয়ে দিই।
তবে সবাই নয়। হয়ত বা কোটিতে গুটিক কয়েকজন আছে যারা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে পাশ ফিরে না শুয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে ওঠে “আমি তো তোমাদেরই সন্তান, সুপারনোভার বিস্ফোরণে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া তারাদের ধুলো থেকেই তো আমার এই নশ্বর দেহটার সৃষ্টি। কিন্তু বায়োকেমেস্ট্রি কবে কিভাবে বায়োলজি হয়ে গেল, আর সেই বায়োলজির স্থূল দেহটার মধ্যে কখন কী ভাবে চেতনা জেগে উঠে পান্নাকে সবুজ আর চুনীকে লাল বলতে শেখাল? কখন আমাকে প্রশ্ন করতে শেখাল কে আমি? কোথায় ছিলাম, আর কোথায় যাব? আর তার চেয়েও বড় কথা, কেন এলাম? কে বলে দেবে?”
‘একা অন্য’-এর প্রটাগনিস্ট সেই কোটিতে গুটিকের একজন। সে ভাবে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। সে নিজেকেই প্রশ্ন করে এই জীবনের আসল অর্থটা কী? তাই সে একা। তাই সে অন্য।
পাঠকরা এই অনন্য ‘মানুষ’-টির সঙ্গে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে ডুবে যাবেন নিজের ভিতরে, হয়ত বা ‘জোহারি উইণ্ডো’-র গোপন ‘C’ জানালা পেরিয়ে গভীর রহস্যময় ‘D’ জানালাটির দিকে।
আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়
দুর্গাপুর
সেপ্টেম্বর, ২০২০
পেশায় প্লাস্টিক সার্জেন, নেশায় লেখক অনিরুদ্ধ বসুর জন্ম ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ কলকাতায়। বি ই কলেজেরস্নাতক ইঞ্জিনিয়ার বাবা স্বর্গীয় বিনয়েন্দ্র মোহন বসু ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রৌপ্য পদক প্রাপ্ত বাংলার স্নাতকোত্তর মা স্বর্গীয় ইলা বসু-র উৎসাহে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ। পরে ইউনাইটেড কিংডমের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেনস থেকে এফ আর সি এস। ইংল্যান্ডে বহু বছর কাটিয়েছেন। দু-বছর মধ্য প্রাচ্যেও। এখন কলকাতার প্রখ্যাত প্লাস্টিক সার্জেন। দেশে ও বিদেশে অন্যতমদের মধ্যে একজন।
ছোটবেলা থেকেই লেখায় আসক্তি। স্কুল পত্রিকা ‘নিহিল উল্ট্রার’ সম্পাদক পদের দায়িত্বে থাকাকালীন নিয়মিত সাহিত্যচর্চা। বহু পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি। পরে ইংল্যান্ড ও কুয়েতে সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ।
নিয়তি কেন বাধ্যতে। অনেক সময় নিয়তি বিভিন্ন আঙ্গিকে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ব্যস্ততার মধ্যে ২০০৬ শালে পায়ের হাড় ভেঙে ছ’মাস হুইলচেয়ারে থাকাকালীন সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় পুনরায় লেখালেখি শুরু। সেই সময় ‘অন্বেষণ’ উপন্যাস রচনা। যা প্রকাশিত হয় ২৫ আগস্ট ২০০৭-এ। নতুন আঙ্গিকের এই উপন্যাস সাড়া ফেলে দেয় সংস্কৃতি মহলে। বেস্টসেলার শুধুই হয়নি, ব্যস্ত প্র্যাকটিসের মধ্যেও লেখায় অনুপ্রেরণা জোগায়। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নিঃশব্দেও বেস্টসেলারের খাতায় নাম লেখায়। শুধু তাই নয়, লন্ডন বুক ফেয়ার ও জাতীয় মাধ্যমে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ভবিতব্য নতুন সৃষ্টির দিক খুলে দিগন্তে নতুন দিশার আলো দেখায়। বহু দেশ থেকে সংগৃহীত মানুষ, সমাজ, উপলব্ধি বন্দি হয় তার লেখনীর বিভিন্ন আঙ্গিকে। ব্যস্ততার মধ্যেও সময় খুঁজে নেয় নতুন চেতনার রচনাশৈলীতে। খুনের গল্পের বিবর্তন থেকে বৈজ্ঞানিক দর্শন তার লেখাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।
এই উপন্যাসটি একা অন্য ভিন্ন স্বাদের। বারবার নিজেকে ভাঙার মধ্যেই তার নতুনত্বের প্রকাশ। প্র্যাকটিসের বাইরে সেখানেই তার শান্তি। তার প্রতিটা উপন্যাস মৌলিক চিন্তাধারার ফসল। অনেক ক্ষেত্রে সাবেকিয়ানা ভেঙে বেরবার প্রয়াস। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সত্যকে নতুন করে খুঁজে চিনতে। তাকে লেখনীর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে।
রবীন্দ্রসংগীত, ক্লাসিক্যাল সংগীতের অনুরাগী অনিরুদ্ধ বসুর শান্তির নীড় স্ত্রী স্মৃতি বসু।