লেখালেখি খুব কঠিন কাজ। হাজার হাজার শব্দ বোনা তো আরও কঠিন। উপন্যাস লিখব, ভাবিনি কখনও। পাঁচশ শব্দ গুছিয়ে লিখতেই কালঘাম ছুটে যায়! সেই ভয়ে ছোটগল্পও লিখি না তেমন। তারা আসেও না আমার কাছে। টুকরো লেখালেখি নিয়েই দিব্যি ছিলাম। কিন্তু ‘আবছা অ্যালবাম’ লেখা হয়ে গেল আচমকা, ঝোঁকের বশে। তাও আবার একটা নয়, পরপর দুটো। কিন্তু সে তো আলাদা! সেখানে প্রত্যক্ষভাবে আমি আছি, আমার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কলকাতা শহর... সব আছে। আমাদের চেনা অলিগলি, ক্যান্টিন, ক্লাসরুম, আড্ডা, গুলতানি, তর্কবিতর্ক... সব। ‘আবছা অ্যালবাম’ লিখতে বসে আমাকে স্মৃতির ধুলোবালি পরিষ্কার করে মনের পুরোনো ঘরবাড়ির ছবি তুলে পরপর সাজাতে হয়েছিল শুধু। কিন্তু ‘নয়না আর জোনাকিগাছ’ তো তা নয়! এ তো অন্যভাবে শব্দ বুনে চলা, যা পরপর আপন খেয়ালে এগোতে এগোতে কখন যেন ‘গল্প’ হয়ে যায়!
এই কাহিনিতে আমি নেই কোথাও, আবার হয়তো আছিও বটে। আনাচে কানাচে। কিছু টুকরোটাকরা ঘটনায়, কিছু বাক্যবন্ধ ব্যবহারে, কিছু জীবনদর্শনে বা কিছু এতদিন বলতে চেয়েও বলতে না-পারা মতামতে। আসলে আমাদের সব লেখালেখিতেই আমরা নিজেরা কোথাও না কোথাও থাকি, কারণ বৃত্তের ভেতরে থেকে উপলব্ধি বা বাইরে দাঁড়িয়ে উদাসীন অনাগ্রহে যাচাই... যাই করি না কেন, আমাদের নিজেদের প্রত্যেকের দু-জোড়া চোখের ব্যবহার তাতে জড়িত... একজোড়া শরীরের আর অন্য জোড়া মনের। ‘নয়না আর জোনাকিগাছ’ তাই আমার গল্প না হয়েও আমারই গল্প হয়ে থেকে যায়।
আমার দু-তিনজন বন্ধু আছে, যাদের উৎসাহ আর জোরজুলুমের অন্ত ছিল না, যাতে আমি একটা উপন্যাস লেখার প্রয়াস করি। কোন বিশ্বাস থেকে তাদের এমন ধারণা জন্মেছিল জানি না যে, আমি কয়েক হাজার শব্দ দিব্যি লিখে ফেলতে পারব। বলতে গেলে, তাদের কথা দিয়েছিলাম বলেই এই লেখা। রীতিমতো আমার ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে তারা। মিষ্টি কথা, গালমন্দ, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল— কিচ্ছুটি বাদ ছিল না। তাদের নাম আলাদা করে উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন, কারণ সত্যিকারের ‘বন্ধু’র নাম দিনের শেষে শুধু ‘বন্ধু’ই থেকে যায়।
অশেষ কৃতজ্ঞতা টিম সৃষ্টিসুখের রোহণ-সৌরাংশু-সরোজ-রণিতাকে, প্রুফ থেকে প্রচ্ছদ— পুরোটা চমৎকার দক্ষতায় সামলে নেওয়ার জন্য।
এই উপন্যাসে দু-জন নয়না। তারা একেবারেই সমবয়স্ক নয়, তবে কোথায় যেন সমমনস্কতার কারণে অনাবিল সখ্যে তারা পরস্পরের হাত স্পর্শ করে থাকে—
Two Girls there are: within the house
One sits; the Other, without;
Daylong a duet of shade and light
Plays between these.
- Sylvia Plath
ঈশানী রায়চৌধুরী