অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই ভীমপুর আসাননগর লালনমেলার অন্যতম প্রাণপুরুষ, বন্ধু সুব্রত বিশ্বাসকে। লোকগানের সুর কথা মিস্টিসিজমকে অতিক্রম করে তার আত্মাটির স্পর্শ, তার যন্ত্রণার খতিয়ান কখনই পেতাম না তাঁর ক্রমাগত সহায়তা ছাড়া।
এ গল্পের রসদ সংগ্রহের সংখ্যাতীত যাত্রায় আমার সঙ্গী হয়েছেন বাসব চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুনি ঘোষ, দেবজ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায়, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, কণ্ঠশিল্পী পিনাকি চক্রবর্তীর মতন বন্ধুরা। চুর্নির ধারে কুয়াশাছাওয়া রাতে, টোপলা পরাণপুরের কোজাগরী তিথিতে, ভীমপুর আসাননগরের আসরে, আড়ংঘাটায়, জয়দেবে, উত্তরবঙ্গে পায়ে হেঁটে ঘোরায়, গোরভাঙায় রাতের পর রাত, আসরের পর আসর তাঁরা আমার সঙ্গে থেকেছেন। একসঙ্গে গান শোনা, গান নিয়ে আলোচনা, গানে ডুব দেয়া, আর তার সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে গড়ে তোলা গল্প-শরীর! তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
গোরভাঙার মনসুর ফকিরদাদার সঙ্গ পেয়েছি। থেকেওছি তাঁর বাড়িতে গিয়ে। বিচিত্র প্রতিভাধর, তীক্ষ্ণধী এই খেয়ালি সুরস্রষ্টার সঙ্গ এ লেখার গড়ে ওঠবার পক্ষে অপরিহার্য ছিল। অথবা আমিরুল ফকির, রাত বারোটায় লিখতে লিখতে হঠাৎ কথার স্রোত শুকিয়ে উঠতে যাকে নিঃসংকোচে ফোন করে বলা যায় — “একটা গান শোনাও দেখি।” কাঁচা ঘুম ভেঙে ওঠা কৃষকশিল্পী জবাবে বলেছে, “একটুক ধরো দাদা। দোতরাটা —” আর তারপর গেয়ে উঠেছে, “পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই গো আমি রই —” আমার কলম ফের এগিয়ে গেছে তার সুরকে ভর করে। অথবা বীরভূমের সুধীরদাসদাদা। অজয়ের ধারে জয়দেবের মেলায় তাঁর আখড়ার এক কোণে চুপটি করে বসে বসে কান খাড়া রেখে কত গল্প শুনেছি। তাঁদের জীবনচর্যা, আনন্দবেদনা, বর্তমানের ধাক্কায় তাঁদের মনোজগতের উথালপাথালের সন্ধানও জুটেছে তাঁর আখড়ার সেইসব আসরের থেকে।
হরিদাসীদি, আপনি আমাকে বারদুয়েক দেখেছেন, কিন্তু চিনবেন না। আলাপ হয়নি তো। দূরদেশ থেকে এই দেশে এসে এখানকার বাউলপুরুষকে, তার দর্শনকে ভালোবেসে এ দেশকে আপন করে নিয়ে আপনি যে জীবনটি তৈরি করে নিয়েছেন, তার ছবিটি পেয়েছি আপনাকে নীরবে পর্যবেক্ষণ করে, অন্যের সঙ্গে আপনার কথোপকথনের সময় কান খাড়া করে শুনে।
সেইসঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাই অগণিত বাউল, ফকির, ঝুমুর, ভাওয়াইয়া, চটকার শিল্পীদের, গত দেড় দশক ধরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে যাঁদের কাছে গান শোনবার সৌভাগ্য হয়েছে।
আমি পণ্ডিত নই। বাংলার অলোকপন্থী সুরসাধনা বা অন্যান্য ধারার লোকগীতির অ্যাকাডেমিক মূল্যামূল্য বিচার করবার সাধ্যও আমার নেই। সে দাবিও করি না। শুধু চোখ ভরে দেখা, কান ভরে শোনা এই দুটি সম্বল করে গড়ে ওঠা এই গল্পকে তার অংকুরোদ্গমের কাল থেকে যিনি সাদর প্রশ্রয় দিয়ে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় দীর্ঘ তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে গিয়েছেন, পরবাস-এর সম্পাদক সেই শ্রী সমীর ভট্টাচার্যকে আমার অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জানাই। সমীরদা, আপনি ক্রমাগত খুঁচিয়ে না গেলে এ লেখাটা হয়তো কোনওদিনই লেখা সম্ভব হত না।
এবং শ্রীমতী মৌসুমীকে। পেশাগত ব্যস্ততার বাইরে সবটা সময়ই যখন মেলা থেকে মেলান্তরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে, তখন নিজের পেশা আর সংসার দুই সামলে আমাকে কাজটা স্বস্তিতে করবার সুযোগ সে করে দিয়েছে। এ লেখার প্রতিটি পর্বের প্রথম পাঠক এবং কঠোরতম সমালোচকের কর্তব্যটিও পালন করে গেছে সব সামলে-সুমলে।
সবাইকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানালাম।
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য