তাপস যখন চলে যায়, তখন আমি জেগে। আরও ঘণ্টা পাঁচেক আগে, ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলা এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে ফেসবুকে, তুমুল আড্ডা মারছি দুজনে, তার মধ্যেই, আমরা কেউই খেয়াল করিনি, টুক করে কখন যেন সরে গেল তাপস। ‘Life is meaningless, why on earth?’ – এইরকম একটা ঢপের স্ট্যাটাস অর্কুটের দেয়ালে সেঁটে দিয়ে ছেঁটে ফেলল নিজেকে, আমাদের এই বিশ্রী চ্যাটচ্যাটে দিনযাপন থেকে। পরদিন সকালে অনির্বাণ বলল, “মিতুল, শুনেছ...?” তার পরের তিনদিন কীভাবে কেটেছে জানি না। আমার একলা ঘরের মধ্যে, ল্যাপটপের ওয়ালপেপার সেই ছবিটা, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে তাপস, চোখের পাতা নড়ে উঠছে, যাকে বলে ব্লিংক করা, মনে হচ্ছে এক্ষুনি দুটো-চারটে লাইন শুনিয়ে দিয়ে বলে উঠবে, এটার ছন্দ ঠিক আছে বল, আর পালটাতে পারব না মাইরি! আর আমি বলব, হয়নি তাপস, এখনও দুমাত্রা।
এই দুমাত্রা, একমাত্রা নিয়ে কী যে টানাটানি হত। কবিয়াল বেরোবে, লেখা চাই, গোটা লেখার খাতা বগলদাবা করে আমাদের গৌর লাহা স্ট্রিটের বাড়িতে হাজির। ছন্দ নিয়ে ধুন্ধুমার হত প্রত্যেকবার। একটার পর একটা লেখা পড়ে শোনাত আমাকে। আমি বলতাম, এখানে একটা মাত্রা গুঁজে দে তাপস, ওখানে দুটো মাত্রা, গুঁজে দে। এই গোঁজাগুঁজির খেলাটা ও বুঝত না। ওর কবিতা ছিল জলের মতো। স্বাভাবিক শ্বাস নেওয়ার মতো। দু-এক মাত্রার চোরা ঢেউ অথবা হেঁচকি, কোনওটাই তাপস নিতে পারত না। ও চলে যাওয়ার পর, প্রায় আষ্টেপৃষ্টে ওকে পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, ও যেন এই পৃথিবীর কেউ ছিলই না। যেন প্রায় সেরামিক নীল, যেন তামাকপাতার মতো অদ্ভুত বাদামি, নেশা আর প্রেম, মায়া আর বিষাদে মাখামাখি এক সংকেতের তীর্থে ও হেঁটে বেড়াত, সমুদ্র-সারেঙের মতো, রক্তছাপ পিঠে নিয়ে শুয়ে থাকত লবণের দ্বীপে। ‘শব যদি ছুঁয়ে যাবি এ ছাই লেখার মানে নেই’, চোখে আঙুল দিয়ে ও বলতে চেয়েছে কতবার, নিজের জ্যান্ত, ধুকপুক করতে থাকা লেখালিখি দিয়ে, কতবার যে! ‘এ বাড়ি আমার। তবু, এ ঠিক আমার বাড়ি নয়। / কত সহজেই লেখা এসব সরলরেখা তোমার মাথায় ঢুকে পড়ে।’ তাপস কি খুঁজে পেয়েছিল ওর বাড়ি? জানি না।
তাপসের ফোনগুলো আসত প্রায় ধূমকেতুর মতো, আর আমি প্রমাদ গুনতাম। একদিন ফোন করে বলল, “মিতুল প্রচুর লিখছি, বই করব, লেখাগুলো নিয়ে শিগ্গির যাচ্ছি তোর বাড়ি।” তার প্রায় তিনমাস পরে কফি হাউসে দেখা হল, সেটাই শেষ দেখা, রাজর্ষিও ছিল, বললাম, “কী রে তাপস, ম্যানুস্ক্রিপ্ট কই? বই করবি বললি যে।” বলল, “না রে, বইটা আর হল না।” আমি বললাম, “কিন্তু লেখাগুলো কোথায়?” বলল, “পরের দিন দেখাব।” পরের দিন আর আসেনি। মাঝখানে একদিনই, ফোন করে বলেছিল, “অনেক কথা আছে, তুই কবে কলকাতায় থাকবি বল তো?” কী বলতে চেয়েছিল ও?
অল্পবিস্তর লেখালিখির চেষ্টা আমরা প্রত্যেকেই করেছি, এই রাস্তাতেই আমাদের জানাশোনা, বন্ধুত্ব। তাপসের সঙ্গে বন্ধুত্বটা একটু বেশিই ছিল, কারণ ওর মধ্যে কোনও দেখানেপনা ছিল না, ছিল না নিজের লেখা নিয়ে অহেতুক আদিখ্যেতা। খোলা দরজার মতো এই ছেলেটা কেন যে শেষ মুহূর্তে বেঁচে থাকার সমস্ত ঘুলঘুলিগুলো বন্ধ করে দিল, তা নিয়ে ভাবব না আর। বরং ভাবি ওর লেখালিখি নিয়ে। ভাবি এই বইটা নিয়ে। পাঠক, আপনারাও পড়ুন, জানুন তাপসকে। দরকার হলে, ছন্দ নিয়ে তর্কও জুড়ে দিন। দুমাত্রা তিনমাত্রার অহেতুক, অনাবশ্যক গোঁজামিল নিয়ে।
কে জানে, অক্ষরবৃত্তের থেকে বহুদূরের কোনও মেঘের বসতি থেকে, ও হয়তো নেমেও আসতে পারে।
মিতুল দত্ত